
নিজস্ব প্রতিবেদক : কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির কয়েকটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে আসছে গরু। বিজিবিকে ফাঁকি দিয়ে রাতের আঁধারে নিয়ে আসা এসব গরু-মহিষ স্থানীয় হাটবাজার থেকে দেশি পশু হিসেবে পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন হাটে। এতে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন স্থানীয় খামারিরা।
মিয়ানমার থেকে পশু আমদানির বৈধ করিডরের অবস্থান টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে। ৩ বছর ১১ মাস ধরে করিডর দিয়ে পশু আমদানি বন্ধ আছে। খামারিদের অভিযোগ, বৈধ করিডর বন্ধ থাকলেও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে পশু চোরাচালান হচ্ছে। জেলার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন পশুর হাটে গিয়ে এই অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
চোরাই পশুর কারণে একদিকে সরকার যেমন রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় খামারিদের পশু বিক্রি হচ্ছে না। কক্সবাজার খামার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম বলেন, মিয়ানমারের চোরাই গরু-মহিষ সস্তায় বিক্রি হওয়ায় খামারের পালিত কোরবানির পশু লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে। মিয়ানমারের চোরাই পশুর গায়ে বিশেষ চিহ্নের সিল মারা থাকে। স্থানীয় হাটবাজারে সিল মারা পশু বিক্রি হলেও কেউ ধরছে না।
যেভাবে চোরাই পশু দেশি হয়
চোরাই গরু-মহিষ রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির কয়েকটি বাজারে আনার পর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সনদপত্র নিয়ে দেশি পশু হিসেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন খামারিরা। বিজিবি ও পুলিশের অভিযানে কিছু পশু ধরা পড়লেও বেশির ভাগ পাচার হয়ে যাচ্ছে। চোরাই পশুর বেশির ভাগ রোগাক্রান্ত। সীমান্তে চোরাই পশু পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। দেশীয় হাটবাজারে স্থানীয় গরু-মহিষের সঙ্গে চোরাই পশু বেচাবিক্রি হওয়ায় রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় খামারিরা।
পশু ব্যবসায়ী ও খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাইক্ষ্যংছড়ির ১৭ কিলোমিটার সীমান্তের কম্বনিয়া, তুমব্রু, বাইশফাঁড়ি, চাকমাপাড়া, জলপাইতলী, হাতিরছড়া, ফুলতলী, ভাল্লুকখাইয়া, দোছড়িসহ ১২টি পয়েন্ট দিয়ে পশু আনা হচ্ছে। সম্প্রতি বিজিবি তৎপর হলে সিন্ডিকেট সদস্যরা পাশের আলীকদম ও লামা সীমান্ত দিয়ে পশু আনা শুরু করেছে।
মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থানকারী সে দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠী, সীমান্তের এপারে সন্ত্রাসী দল ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে চাঁদা দিয়ে একটি গরু মিয়ানমার সীমান্ত থেকে রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির বাজার পর্যন্ত পৌঁছে দেয় পাচারকারীরা। এভাবে কয়েক দফায় একটি গরুর জন্য ১৭ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয় বলে এ কাজে নিয়োজিত একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানান।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান তোফাইল আহমদ বলেন, বিজিবি তৎপর হওয়ায় সম্প্রতি পশু চোরাচালান কিছুটা কমলেও পাচার থেমে নেই। পশুর সঙ্গে ইয়াবার চালান দেশে ঠেলে দিচ্ছে ওপারের সশস্ত্র গোষ্ঠী।
ব্যবসায়ীরা জানান, আগে চোরাই পশু দেশি হিসেবে বৈধ করার জায়গা ছিল গর্জনিয়া বাজার। চোরাই পথে আনা মিয়ানমারের ৮০ শতাংশ পশু বিক্রি হতো এই বাজারে। চলতি ২০২৫ অর্থবছরে গর্জনিয়া বাজারের ইজারা মূল্য ১০ গুণ বেড়ে ২৬ কোটিতে দাঁড়ায়। আইনি জটিলতায় ওই বাজারের ইজারা সম্প্রতি স্থগিত করে রামু উপজেলা প্রশাসন। এরপর কোরবানির পশু বিক্রির জন্য পাশের কচ্ছপিয়া বাজারটি উন্মুক্ত করা হয়। সেখানেও স্থানীয় পশুর পাশাপাশি চোরাই গরু-মহিষ বিক্রি হচ্ছে। চোরাই পশু নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের চাকঢালা বাজার, রামুর কচ্ছপিয়া বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছার পর সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানেরা সনদপত্র দিয়ে দেশি পশু বানিয়ে দেন। এরপর চোরাই পশু ট্রাকে ভরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হয়।
গর্জনিয়া বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এরশাদ উল্লাহ বলেন, সীমান্ত দিয়ে গরু-মহিষ ঢুকে পড়ায় স্থানীয় খামারিরা বিপাকে পড়েছেন। গর্জনিয়া বাজারটি বন্ধ করায় খামারিদের কয়েক কিলোমিটার দূরে কচ্ছপিয়া বাজারে গিয়ে কোরবানির পশু বিক্রি করতে অতিরিক্ত টাকা খরচ হচ্ছে। মিয়ানমারের গরু-মহিষ দেখলে চেনা যায়, শরীরে বিশেষ সিল মারা থাকে। তবে এরপরও ধরা হচ্ছে না।
কক্সবাজারের রামুর একটি পশুর হাট। এই হাট থেকে অল্প দূরত্বে মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকা। খামারিদের অভিযোগ, এ ধরনের হাটে আনা পশুর একটি অংশ মিয়ানমারের চোরাই পশু। সম্প্রতি তোলা
পাচারকারীরা চিহ্নিত হলেও অধরা
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত থেকে পাচার হওয়া পশু কারা কক্সবাজারের বিভিন্ন বাজারে পৌঁছে দিচ্ছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী দলের নাম বলেন স্থানীয় পশু ব্যবসায়ী ও খামারিরা। এর মধ্যে গর্জনিয়ার মাঝিরকাটা এলাকার শাহীনুর রহমান নামের একজনের কথা জানা গেছে। হত্যা, ডাকাতি, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদকসহ ১৯টি মামলার পলাতক আসামি শাহীনুরের সন্ত্রাসী বাহিনী ৭০ শতাংশ পশু চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত বলে এলাকার খামারিরা জানিয়েছেন।
গত রোববার ভোররাতে শাহীনুর রহমানের বাড়িতে অভিযানও চালায় পুলিশ-বিজিবির যৌথ দল। অভিযানে তাঁর ঘর থেকে ২টি ১২ বোর কার্তুজসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র, গুলির খোসা, গাঁজা, জাল টাকা, ওয়াকিটকি সেট, বাইনোকুলার উদ্ধার করা হয়। তবে শাহীনকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। এ বিষয়ে র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের সহকারী পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) আ ম ফারুক বলেন, শাহীনকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান থেমে নেই। সীমান্তের দুর্গম এলাকায় অবস্থান করায় তাঁকে ধরা যাচ্ছে না।
বন্ধ বৈধ করিডর
চোরাই পথে পশু আনা নিরুৎসাহিত করতে ২০০৩ সালের ২৫ মে থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ করিডর চালু করা হয়। খামারিদের লাভের কথা বিবেচনা করে ২০২১ সালের ৪ জুলাই করিডর দিয়ে পশু আমদানি আবার বন্ধ করে দেয় কক্সবাজার জেলা চোরাচালান নিরোধ টাস্কফোর্স কমিটি।
দক্ষিণ চট্টগ্রামে এটি ছাড়া পশু আমদানির দ্বিতীয় কোনো করিডর নেই। সর্বশেষ ২০২১ সালের জুন মাসে ওই করিডরে আমদানি হয়েছিল ২৫ হাজার ৮৬৮টি গরু ও ৪ হাজার ২৫৮টি মহিষ। পশু আমদানির বিপরীতে সরকার রাজস্ব আদায় করেছিল ১ কোটি ৫০ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। গরু ও মহিষে রাজস্ব ৫০০ এবং ছাগলে ২০০ টাকা।
টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, বন্ধের আগের ১৮ বছরে করিডর দিয়ে পশু আমদানি হয়েছিল প্রায় ৯ লাখ। এর বিপরীতে সরকার রাজস্ব পেয়েছিল ৩৬ কোটি ৮০ লাখ ৬৯ হাজার ৪০০ টাকা। এ হিসাবে প্রতিবছর রাজস্ব আদায় হতো দুই কোটি টাকা। কিন্তু করিডর বন্ধ করে স্থানীয় খামারিদের লাভ হয়নি।
মিয়ানমারের পশু আমদানির একমাত্র বৈধ করিডোর ছিল টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের এই জেটি। গত চার বছর ধরে এই করিডোর বন্ধ থাকলেও অবৈধ পথে পশু আনা বন্ধ হয়নি। সম্প্রতি তোলা
গত শুক্রবার দুপুরে করিডরে গিয়ে দেখা গেছে, পশু রাখার বিশাল মাঠ খালি পড়ে আছে। করিডরে সামনে নাফ নদীতে নির্মিত জেটিও ফাঁকা পড়ে আছে। আগে এই জেটি দিয়ে আমদানির পশু খালাস করা হতো।
করিডর থেকে পশু কিনে টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, লোহাগড়া, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হতো জানিয়ে শাহপরীর দ্বীপের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ কাশিম বলেন, পাঁচ বছর ধরে করিডর বন্ধ থাকলেও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান থেমে নেই। ব্যবসায়ীরা নাইক্ষ্যংছড়ি, রামু ও কক্সবাজারের বাজার থেকে চোরাই গরু-মহিষ কিনে টেকনাফে এনে চড়া মূল্যে বিক্রি করছেন।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, সরকারের নির্দেশনায় শাহপরীর দ্বীপ করিডর বন্ধ রাখা হয়েছে। চালুর ব্যাপারে নির্দেশনা আসেনি।