
নিজস্ব প্রতিবেদক :চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ডাকাত সন্দেহে একটি পক্ষকে ঘিরে ফেলার ঘটনায় দুপক্ষের মধ্যে গুলিবর্ষণ ও হামলা-পালটা হামলার ঘটনা ঘটেছে। একপক্ষ নেজাম উদ্দিন (৪৫) ও আবু ছালেক (৩৫) নামে দুজনকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরো অন্তত ৫ জন।
সোমবার(৩ মার্চ) মধ্যরাতে উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে চূড়ামণি গ্রামের ছনখোলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত এলাকাবাসীর মধ্যে ওবায়দুল হক (২২), নাসির উদ্দিন (৩৮), আব্বাস উদ্দিন (৩৮) ও মো. মামুনুর রশিদ (৪৫) এর নাম পাওয়া গেছে। তাদের রাতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশি পিস্তল,৮টি গুলির খোসা ও একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা জব্দ করেছে।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিকের সঙ্গে জামায়াত কর্মী নেজাম উদ্দিনের বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তারের জের ধরেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ, এলাকাবাসীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
সাতকানিয়া উপজেলা জামায়াতের আমির কামাল উদ্দিন বলেন, হামলায় নিহত দুজন তাদের সক্রিয় কর্মী। তাদের সালিশের নামে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত নেজাম উদ্দিন উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চনা এলাকার মাহমুদুল হকের ছেলে এবং আবু ছালেক একই ইউনিয়নের গুরগুরি এলাকার আবদুর রহমানের ছেলে। হামলায় তাদের পুরো শরীর ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত হয়ে গেছে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শিল্পাঞ্চল ও ডিবি) রাসেল বলেছেন, প্রাথমিকভাবে দুপক্ষের আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরেই এমন ঘটনা ঘটেছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। তবে তদন্তের পর বিস্তারিত বলা যাবে। মঙ্গলবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি। জড়িত কেউ গ্রেফতার হয়নি। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সোমবার তারাবিহ নামাজের পর একটি মোটরসাইকেল ও ৮-৯টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা যোগে কাঞ্চনা ইউনিয়ন থেকে এওচিয়া ইউনিয়নে যান নেজাম উদ্দিনের নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জন লোক। সদলবলে তাদের এমন উপস্থিতিতে দেখে এলাকাবাসী শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা ডাকাত সন্দেহে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেন গ্রামে ডাকাত পড়েছে বলে।
মাইকের ঘোষণা শুনে এলাকাবাসী সংঘবদ্ধ হয়ে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ হাতের কাছে যা পেয়েছে তা নিয়ে বের হয়ে পড়েন। তারা নেজাম ও তার সহযোগীদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এ সময় নেজামের লোকজন এলাকাবাসীর ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। একপর্যায়ে তারা নেজাম ও আবু ছালেককে ধরে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। অন্যদিকে নেজামের সহযোগীদের গুলিতে আহত হন ৫ এলাকাবাসী।
স্থানীয় অপর একটি সূত্র বলেছে, এলাকাবাসীর পক্ষ থেকেও পাল্টা গুলিবর্ষণ করা হয়। আধঘণ্টা ধরে গোলাগুলিতে শতাধিক রাউন্ড গুলি বিনিময় হয়। এ সময় পুরো ছনখোলা এলাকায় অবর্ণনীয় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
হতাহতদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। ঘটনার পর রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যায় সেনাবাহিনীর স্থানীয় একটি টিম ও সাতকানিয়া থানা পুলিশের একটি টিম। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সাইফুল ইসলাম, সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস ছাড়াও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি টিমও রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখা যায়, নিহত নেজাম ও ছালেকের স্বজনরা আহাজারি করছেন। তাদের আহাজারিতে মর্গের বাতাস ভারি উঠেছে।
মর্গ সূত্র জানিয়েছে, নিহত দুইজনকে উপর্যুপরি কোপানো হয়েছে। নির্দয়ভাবে কোপানোর কারণে নেজামের মাথার মগজ বেরিয়ে গেছে। তাদের শরীরে শতাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। বেশিরভাগ আঘাতই মাথা আর ঘাড়ে। অর্ধ শতাধিক কোপে নেজামের মুখমণ্ডল অনেক বিকৃত হয়ে গেছে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে নেজামের পায়ের রগও কেটে দেওয়া হয়েছে।
জামায়াত নেতা শাহাদাত হোসেন বলেন, মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দুজনের মাথায় পর্যায়ক্রমে আঘাত করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।
নিহত দুইজনের বিরুদ্ধে সাতকানিয়া থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। নেজামের বিরুদ্ধে সাতকানিয়ার মুক্তিযোদ্ধা মফিজুল রহমান ও মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ কাদেরীসহ একাধিক মামলা রয়েছে। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ধরপাকড় শুরু করলে বিদেশে চলে যান নেজাম। দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন তিনি। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে নেজাম এলাকায় ফিরে আসেন।
নেজাম ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে এওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিকের ঘরবাড়ি ভাঙচুর লুটপাট, তার মালিকানাধীন ব্রিকফিল্ড থেকে কোটি কোটি টাকার ইট লুট করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মানিক আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান ছিলেন বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।
হামলায় নিহত ছালেকের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেশ কিছুদিন জেলও খাটেন। এরপর জামিনে বের হন তিনি।