বিশেষ প্রতিনিধি : চট্টগ্রামে দিনে দুপুরে আফতাব উদ্দিন তাহসিন (২৬) নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে গুলি করে হত্যা করেছে ‘সাজ্জাদ বাহিনী’। সোমবার (২১ অক্টোবর) বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে নগরের চান্দগাঁও থানার শমসের পাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহত আফতাব উদ্দিন তাহসিন চান্দগাঁও থানাধীন হাজিরপুল এলাকার মোহাম্মদ মুসার ছেলে। স্থানীয় ছাত্রলীগের এই কর্মী নগরের ওমরগণি এম.ই.এস. কলেজের ছাত্র ছিলেন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য আরশাদুল আলম বাচ্চুর অনুসারী হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তবে ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিলেন না। পড়াশোনার পাশাপাশি ইট ও বালুর ব্যবসা করতেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শিবির-ক্যাডার হিসেবে পরিচিত সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ তার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে মাইক্রোবাসে এসে গুলি করে চলে যান। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার সময়ে আশপাশে লোকজন থাকলেও ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, চান্দগাঁও থানার শমসের পাড়ার উদুপাড়া এলাকায় আফতাব তার ব্যবসার জন্য আনা বালু ও ইট রাখেন। বিকাল সোয়া ৪টার দিকে মজুতের জন্য এক ট্রাক বালু আনা হয়। এ কারণে আফতাব সেখানে আসেন। কিছুক্ষণ পর সেখানে একটি নোহা মাইক্রোবাস আসে। প্রথমে গাড়ির ভেতর থেকে আফতাবকে লক্ষ্য করে একটি গুলি ছোড়া হয়। এরপর ছোট সাজ্জাদ ও তার সহযোগী মাহমুদ, হাছানসহ চার জন গাড়ি থেকে নেমে গুলি করতে থাকেন। তারা আফতাবের ঊরু ও পায়ে পরপর চারটি গুলি করে চলে যান। এতে মৃত্যু হয়। আশপাশে লোকজন থাকলেও ভয়ে এগিয়ে আসেননি কেউ।
নিহত আফতাবের ছোট ভাই মো. তানভীর হোসেন বলেন, ‘সন্ত্রাসী সাজ্জাদের বিরুদ্ধে আমার ভাই ফেসবুকে লেখালেখি করতেন। ইট ও বালুর ব্যবসা করতে হলে ভাইয়ের কাছে চাঁদাও চেয়েছেন। এ কারণে দুই মাস আগে আদালতে জিডি করেন। আজ বিকালে প্রকাশ্যে সাজ্জাদ ও তার বাহিনী গুলি করে হত্যা করে চলে যান। পরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় মামলা কিংবা অভিযোগ করেও কোনও লাভ হবে না। কারণ সাজ্জাদকে কেউ গ্রেফতার করবে না।’
একটি সূত্র জানিয়েছে, শমসেরপাড়া এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সরোয়ার ও সাজ্জাদ গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলছিল। নিহত তাহসিন সরোয়ার গ্রুপের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিল। এ কারণে সাজ্জাদ গ্রুপের লোকজন তাকে হত্যা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চান্দগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সবেদ আলী জানান, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সরোয়ার ও সাজ্জাদ গ্রুপের বিরোধ ছিল। বিরোধকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, ‘সন্ত্রাসী সাজ্জাদই গুলি করে হত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’
জানা যায়, গত ১৮ সেপ্টেম্বর নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার কালারপুল এলাকার একটি নির্মাণাধীন ভবনের পাঁচ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে সেখানে গুলি ছুড়েছেন সাজ্জাদ ও তার বাহিনী। এ ঘটনাটি সিসিটিভি ফুটেজে উঠে আসে। তবে ভয়ে ভবন মালিকরা মামলা করেননি। ওই ঘটনার আগে ৩০ আগস্ট একই এলাকায় দুজনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। মামলায় আসামি করা হয় সাজ্জাদ ও তার সহযোগীদের। কিন্তু এরপরও গ্রেফতার করেনি পুলিশ। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
কে এই জুনিয়র সাজ্জাদ?
চট্টগ্রামের একসময়ের দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ আলী খান ২০০০ সালের ১ অক্টোবর একে-৪৭ রাইফেলসহ গ্রেফতার হন। ২০০৪ সালে জামিনে বেরিয়ে বিদেশে পালিয়ে যান। বিদেশে পলাতক সেই সাজ্জাদ আলীর সহযোগী হিসেবে এই সাজ্জাদ অপরাধ-জগতে পা রাখেন। এরপর দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও হাটহাজারী এলাকায় নতুন বাড়ি নির্মাণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমি বেচাকেনা করলেই কল আসে বড় সাজ্জাদের। চাঁদা দিতে গড়িমসি করলেই বিপদ। বাহিনী দিয়ে কখনও গুলি চালিয়ে ঘরবাড়ি ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। কখনও আবার পেট্রোল বোমা ছুড়ে ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে একই পদ্ধতিতে চাঁদাবাজি চালিয়ে আসছেন বড় সাজ্জাদ।
এই কাজে ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন নুরুন্নবী ম্যাক্সন ও সরোয়ার হোসেন ওরফে বাবলা। এর মধ্যে ম্যাক্সন ভারতে মারা গেছেন বলে জানা যায় । ইতিমধ্যে সাজ্জাদের পক্ষ ত্যাগ করে নিজেই এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন সরোয়ার। তাই বিদেশে থাকা বড় সাজ্জাদের অন্যতম সহযোগী হয়ে উঠেছেন জুনিয়র সাজ্জাদ। তারই ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকার করলেই ঘরবাড়িতে হামলা চালান। প্রতিবাদ করলে গুলি করেন। এখন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাজ্জাদ ও সরোয়ারের নিয়মিত অস্ত্রের মহড়া চলে অক্সিজেন-কুয়াইশ এলাকায়। আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে ২৯ আগস্ট রাতে অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়কে গুলিতে নিহত হন মো. আনিস (৩৮) ও মাসুদ কায়ছার (৩২) নামে দুই যুবক।
এ ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই মামলায় আসামিও হয়েছেন ছোট সাজ্জাদ। গত ১৮ সেপ্টেম্বর পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার কালারপুল এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে প্রকাশ্যে গুলি চালান সাজ্জাদ। যা সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে পুলিশের কাছেও। তার বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির ১০টি মামলা রয়েছে। সর্বশেষ গত ১৭ জুলাই চান্দগাঁও থানা পুলিশ অস্ত্রসহ সাজ্জাদকে গ্রেফতার করেছিলো। আগস্ট মাসে তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। বায়েজিদ বোস্তামী থানা সংলগ্ন হাটহাজারীর শিকারপুরের মো. জামালের ছেলে এই সাজ্জাদ। নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার অক্সিজেন, অনন্যা, শীতলঝর্ণা, কালারপুল, বায়েজিদ থানার সীমান্তবর্তী হাটহাজারীর কুয়াইশ, নগরের চান্দগাঁও হাজীরপুল এবং পাঁচলাইশ এলাকায় ১৫ থেকে ২০ জনের বাহিনী নিয়ে দাপিয়ে বেড়ান ছোট সাজ্জাদ।