ঘোষণা ডেস্ক : শিকলে বেঁধে ২৫ দিন ধরে তরুণীকে ধর্ষণের চাঞ্চল্যকর ঘটনার মূল হোতা কথিত ব্যারিস্টার মাসুদ এখনো অধরা। তার কোনো হদিস মেলাতে পারছে না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া মামলার অন্যতম ক্লু হিসাবে আসামিদের ফোন সেটগুলো এখনো উদ্ধার করতে পারেনি। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ আলামত গায়েব করতে মোবাইল সেটগুলো ফেলে দিয়েছে। তবে কোথায় ফেলেছে সে তথ্য দিচ্ছে না। পুলিশ আশা করছে তিনদিনের রিমান্ডের শেষদিনে বৃহস্পতিবার তারা আসামিদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত তথ্য বের করতে সক্ষম হবেন।
এদিকে তরুণীর (২৩) প্রেমিক আবিদ তাসিন সান (২০) প্রকৃত অর্থে প্রেমে জড়িয়ে এখন এই বিপদে পড়েছেন। কথিত ব্যারিস্টার মাসুদের সঙ্গে তার কোনোদিন কথাও হয়নি। বুধবার(৩ এপ্রিল) এমন দাবি করেন সানের বাবা শাহীন আলম। তিনি বলেন, তার ছেলে তাকে জানিয়েছে ব্যারিস্টার মাসুদ ও সালমা সব অপকর্মের হোতা। তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই সান গানবাজনা করত। পড়ালেখা করত রাজধানীর মোহাম্মদপুরে খালার বাসায় থেকে। গত বছর এইচএসসি পাশ করেছে। মোহাম্মদপুরের গ্রিন সিটিতে গান গাইতেন নিয়মিত। সেখান থেকেই সালমা ও ওই তরুণীর সঙ্গে পরিচয় সানের। গান গাইতে গিয়ে রকি ও হিমেলের সঙ্গেও পরিচয় হয়। তার ছেলে নির্দোষ। খারাপ চক্র তার ছেলেকে এ রকম ফাঁদে ফেলেছে।
ভুক্তভোগী তরুণী ও গ্রেফতারদের ভাষ্য মতে, তরুণীর সঙ্গে সানের প্রেমে বাধা দেওয়া থেকে শুরু করে গোপনে ধর্ষণের ভিডিও ধারণ এবং তরুণীকে পর্নো ভিডিও তৈরিতে বাধ্য করার পেছনে মাস্টার মাইন্ড ছিলেন ব্যারিস্টার মাসুদ। ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার ৪ আসামিকে দুদিন ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেও ব্যারিস্টার মাসুদের কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, কথিত ব্যারিস্টার মাসুদের সঙ্গে ভুক্তভোগী তরুণীর লিভটুগেদারের বিষয়টি তরুণীর স্বজনরা জানতেন। মামলার এজাহারেও ওই তরুণী উল্লেখ করেছেন, তার মেঝ দুলাভাই এর মাধ্যমেই মাসুদের সঙ্গে পরিচয়। সেই সূত্রেই সালমা ও মনি নামের দুই নারীর সঙ্গে তরুণীকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে রাখতেন মাসুদ। তবে ওই তরুণীর দুলাভাই পুলিশের কাছে দাবি করেছে, তিনি মাসুদকে চেনেন না। ওই তরুণীর সঙ্গে দীর্ঘদিন তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। এ অবস্থায় পুলিশ এখন ৩ চরিত্র ও দুটি ক্লুকে সামনে রেখে এগুচ্ছে। ব্যারিস্টার মাসুদ ও তরুণীর ভগ্নিপতি। এছাড়া ভুক্তভোগী তরুণী ও মামলার প্রধান আসামি সালমা ওরফে ঝুমুরের ফোন সেট।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) আজিজুল হক বলেন, ‘আমরা ব্যারিস্টার মাসুদ সম্পর্কে ধোঁয়াশার মধ্যে আছি। সে খুব টেকনিক্যালি সবকিছু হ্যান্ডেল করেছে। আসামিরা দাবি করেছে, মাসুদ বিদেশে আছে। তবে আমাদের ধারণা সে দেশেই আছে।’
তিনি আরও বলেন, ভুক্তভোগী তরুণী ও মামলার প্রধান আসামি সালমার মুঠোফোন উদ্ধার হলে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। আমরা ফোন দুটি উদ্ধারের চেষ্টা করছি।’
শুক্রবার রাতে জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ এর ফোন পেয়ে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের একটি ফ্ল্যাট থেকে শিকলবন্দি অবস্থায় ভুক্তভোগী তরুণীকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে ৪ জনের নাম উল্লেখ করে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করে ওই তরুণী। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, তরুণীকে পৈশাচিকভাবে ধর্ষণই নয়, সংঘবদ্ধভাবে শারীরিক নির্যাতনও চালানো হয়। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতাররা হলেন সালমা ওরফে ঝুমুর (২৮), আবিদ তাসিন সান (২০), সালমান আহমেদ জয় ওরফে রকি (২৭) ও আতিক রহমান হিমেল (২৭)।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানিয়েছে ব্যারিস্টার মাসুদ ওই তরুণীকে দেখভালের জন্য সালমাকে নিয়োগ করে। মাসুদের অনুপস্থিতিতে ওই তরুণী সানের সঙ্গে প্রেম ও দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে । সান নিয়মিত মোহাম্মদপুরের ওই বাসায় গিয়ে ভুক্তভোগী তরুণীর সঙ্গে মেলামেশা করত। এক পর্যায়ে সানের সঙ্গে মেলামেশার বিষয়টি মাসুদকে জানায় সালমা। মাসুদ সালমাকে নির্দেশ দেয় তাদের সম্পর্ক ঠেকানোর। কিন্তু ওই তরুণী সালমার কোনো কথায় শোনেনি। এক পর্যায়ে ওই তরুণী সানকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। কিন্তু সান বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিল না। সেই মুহূর্তে মাসুদের পরামর্শে সালমা সান এবং তার দুই বন্ধু রকি ও হিমেলের সঙ্গে আঁতাত করে তরুণীকে ধর্ষণ করায় এবং সেই মুহূর্তের ভিডিও গোপনে ধারণ করে। বিকৃত সেই যৌনাচারের ভিডিও সালমা মোবাইল ফোনের অ্যাপসের মাধ্যমে কথিত ব্যারিস্টার মাসুদের কাছে পাঠাত।
গ্রেফতার ৪ জনের তিন দিন রিমান্ডের গতকাল বুধবার ছিল ২য় দিন। তারা মাসুদ সম্পর্কে কোনো তথ্য দিচ্ছে না বলে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ফারুকুল। তিনি বলেন, আসামিদেরকে দ্বিতীয় দিনের মতো দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কিন্তু এখনো তাদের কাছ থেকে ব্যারিস্টার মাসুদ সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। শুধুমাত্র মাসুদের নামই আমরা পেয়েছি। আসামিদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনগুলো উদ্ধার করা গেলে মামলা সম্পর্কিত অনেক প্রমাণাদি পাওয়া যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, আসামিরা গ্রেফতারের আগেই তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনগুলো ফেলে দিয়েছে। যাতে আলামত কোনোভাবেই উদ্ধার করা না যায়। বিশেষ করে যে আইনজীবীর নির্দেশে শেকলে বেঁধে অত্যাচার করে ধর্ষণের পর তাকে ভিডিও পাঠানো হতো, মাসুদ নামের সেই ব্যারিস্টারকে আমরা খুঁজছি। এসআই ফারুকুল বলেন, আমরা ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছি। তার মোবাইল ফোনটি আসামিরা ফেলে দিয়ে গায়েব করে ফেলেছে। মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করতে পারলে মামলায় দ্রুত অগ্রগতি হতে পারে।
ডিসি আজিমুল হক বলেন, ‘পুরো ঘটনার নেপথ্যে রয়েছেন একজন ব্যারিস্টার। যিনি এই তরুণীকে ব্ল্যাকমেল করেছেন এবং তাঁর সঙ্গে লিভ টুগেদার করেছেন। তাঁর বিস্তারিত তথ্য আমরা খুঁজছি। তিনি বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। দেশে থাকলে তাঁকে আমরা গ্রেপ্তার করব, দেশের বাইরে থাকলে ইন্টারপোলের সহায়তা নেব।’
পুলিশ জানিয়েছে, নির্যাতনের শিকার ওই তরুণীর মেজো দুলাভাইয়ের মাধ্যমে একজন ব্যারিস্টারের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর সেই ব্যারিস্টারের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয় তরুণীর। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ওই ব্যারিস্টার তরুণীকে বাসা ভাড়া করে দিতেন। সেখানে একাধিক গৃহপরিচারিকা নিয়ে থাকতেন তরুণী। সব খরচ ওই ব্যারিস্টার দিতেন। ব্যারিস্টার বেশির ভাগ সময় বিদেশে থাকতেন, দেশে এলে এই তরুণীর বাসায় উঠতেন ৷ সর্বশেষ মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের ১৬ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে বাসা ভাড়া করে দেন। সেখানে এই তরুণী সালমা ওরফে ঝুমুর নামে এক গৃহপরিচারিকাসহ থাকতেন। তাঁদের দেখাশোনার জন্য সান, হিমেল ও রকি নামে তিন তরুণকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার। তবে ব্যারিস্টার দেশের বাইরে থাকায় এই তরুণী সানের সঙ্গে বেড়াতে যেতেন। তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হয়। নবীনগরের বাসায় তাঁদের নিয়মিত আড্ডা হতো।
বিষয়টি গৃহপরিচারিকা সালমা ব্যারিস্টার জানান, এতে ব্যারিস্টার ক্ষিপ্ত হন। সান রকি ও হিমেলকে বাসায় আসতেন নিষেধ করেন। তবে এতে এই তরুণী আরও ক্ষিপ্ত হন। এরপর ব্যারিস্টার ওই তরুণীকে দিয়ে পর্নোগ্রাফি বানানোর নির্দেশ দেন, সেগুলোর ভিডিও ধারণ করতেন সালমা, সেই ভিডিও নিয়মিত ব্যারিস্টারকে পাঠানো হতো।
আজিমুল হক বলেন, ভুক্তভোগী তরুণীকে নির্যাতনের বেশির ভাগ ভিডিও ও ছবি সালমার মোবাইল ফোনে । কিন্তু তিনি মোবাইলটি লুকিয়ে ফেলেছেন। সেটি পেলে পৈশাচিক নির্যাতনের আসল তথ্য ও ভিডিওর গন্তব্য সম্পর্কে জানা যাবে।
ডিসি বলেন, ‘যেসব ভিডিও ব্যারিস্টারকে পাঠানো হয়েছে, এগুলো পর্নোগ্রাফি সাইটে বিক্রি হয়ে যেতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। কারণ, ভিডিও ধারণ এবং পাঠানোর কৌশল তা-ই বলছে।’