ঘোষণা ডেস্ক : ঢাকা আইনজীবী সমিতির এক শিক্ষানবিশ আইনজীবীকে এক হাজার পিস ইয়াবা দিয়ে ফাঁসাতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তার নাম শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন। তার বিরুদ্ধে স্বপ্না আক্তার নামে শিক্ষানবিশ আইনজীবীকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে মিথ্যা মামলার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। আদালত ভুক্তভোগীকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।
এদিকে স্বপ্নাকে অবৈধভাবে আটক এবং মিথ্যা অভিযোগে মামলা করায় বাদী সাজ্জাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আহসানুর রহমান।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বপ্নাকে এক হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন। চলতি বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আহসানুর রহমান আসামিকে অব্যাহতির সুপারিশ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। একই সাথে মামলার বাদী সাজ্জাদ হোসেন নিজ হেফাজতে থাকা এক হাজার পিস ইয়াবা দিয়ে স্বপ্নাকে গ্রেফতার এবং মিথ্যা মামলা করায় তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলার সুপারিশ করেন।
এরপর ৮ অক্টোবর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোশাররফ হোসেনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে স্বপ্না আক্তারকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। একইসঙ্গে তাকে অবৈধভাবে আটক এবং মিথ্যা অভিযোগে মামলা করায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেন। সিআইডিকে মামলা তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। আদালতের নির্দেশে গত ১৪ অক্টোবর স্বপ্নার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আহসানুর রহমান খিলক্ষেত থানায় সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
স্বপ্নার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিদর্শক রোকেয়া আক্তার, সহকারী উপ-পরিদর্শক মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান ও রুবেল হোসেন, সিপাহি শরিফুল ইসলামসহ তিন পুলিশ ফোর্সের সমন্বয়ে গঠিত রেইডিং টিম স্বপ্না আক্তারের খিলক্ষেতের বাসায় তল্লাশি চালায়।
মামলার বাদী সাজ্জাদ হোসেন পরিদর্শক রোকেয়া আক্তারেরর মাধ্যমে আসামির দেহ ও শয়নকক্ষ তল্লাশি করে পাঁচটি স্লিপারযুক্ত পলি প্যাকেটে রক্ষিত অ্যামফিটামিনযুক্ত মোট এক হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেন। ঘটনাস্থলে জব্দ তালিকা প্রস্তুত করেন ও সাক্ষীদের স্বাক্ষর নেন। এ ঘটনায় রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় স্বপ্নার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন সাজ্জাদ। মামলার পর আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। বর্তমানে তিনি জামিনে মুক্ত।
মামলার তদন্তভার পড়ে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আহসানুর রহমানেরর ওপর। তিনি সাক্ষীদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন। এ সময় অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিদর্শক রোকেয়া আক্তার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে জানান, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি গুলশান সার্কেলের অভিযানে তার নাম যুক্ত করা হয়েছে। ওই তারিখে তিনি অফিসের কার্যক্রম শেষে সন্ধ্যার পরে বাসায় ফিরে তার বড় ছেলেকে নিয়ে বনশ্রীতে ফরাজী হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন।
সহকারী উপ-পরিদর্শক জিয়াউর রহমানও লিখিতভাবে তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেন, ওই অভিযানে তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না।
আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে স্বপ্নাকে অব্যাহতি দিয়ে সাজ্জাদের বিরুদ্ধে মামলা করার আদেশ দেন। এরপর খিলক্ষেত থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আমরা আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন দাখিল করেছি। আদালত তা গ্রহণ করেছেন। রিভিশন গ্রহণের পর সাজ্জাদের বিরুদ্ধে মামলা চলতে পারে না। —সাজ্জাদ হোসেনের আইনজীবী
আরেক সহকারী উপ-পরিদর্শক মো. রুবেল হোসেন তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে লিখিত বক্তব্যে জানান, আসামির ফ্ল্যাট ও দেহ তল্লাশিকালে ও আলামত উদ্ধারের সময় তিনিও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সিপাহি মো. শরিফুল ইসলাম তদন্ত কর্মকর্তার কাছে লিখিত বক্তব্যে বলেন, অভিযান পরিচালনার সময় তাকে মামলার বাদী একটি ফাঁকা জায়গায় অবস্থান করতে বলেন। তল্লাশিকালে ও আলামত উদ্ধারের সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। পরে বাদীর ফোন পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে যান ও দুজন পুলিশের সহযোগিতায় আসামিকে গাড়িতে তোলেন।
জব্দ তালিকার পাবলিক সাক্ষী রিপন মিয়া লিখিত জবানবন্দিতে জানান, তিনি ১৬ ফেব্রুয়ারি অফিস শেষে রাত সাড়ে ১০টায় বাসায় আসেন। বাসায় ঢুকতেই দোতলার ভাড়াটিয়া স্বপ্নার ফ্ল্যাটের ভেতর চার-পাঁচজন পুরুষকে (সরকারি লোক) দেখতে পান। তাকে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করতে বললে তিনি একটি কাগজে স্বাক্ষর করেন। জব্দ করা ইয়াবা তার সামনে উদ্ধার করা হয়নি। এছাড়া তল্লাশির জন্য ওই টিমে কোনো নারী সদস্যও ছিলেন না।
স্বপ্নাকে গ্রেফতার এবং তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিদর্শক শেখ মো. সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর (সংশোধিত ২০২০) ৩৬ (১) সবারণির ১০ (ক) ও ৩৯ ধারায় গত ১৪ অক্টোবর রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় মামলা করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আহসানুর রহমান।
এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ঘটনাস্থলে মাদকের উপস্থিতি থাকলেও কার দখল থেকে কিংবা কার সংরক্ষণ থেকে মাদকদ্রব্যটি উদ্ধার করা হয়েছে সে বিষয়ে সাক্ষ্য প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি। খিলক্ষেত থানার মামলায় স্বপ্না আক্তার কর্তৃক এজাহারে বর্ণিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মর্মেও কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার বিরুদ্ধে করা মামলা তদন্তেও অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
তিনি বলেন, স্বপ্নাকে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৭৩ (৩ ক) ধারা মোতাবেক চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছি। আদালত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলার দায় থেকে স্বপ্নাকে অব্যাহতি প্রদান করেন। ওই মামলার বাদী সাজ্জাদ হোসেন নিজ হেফাজতে এক হাজার পিস ইয়াবা দিয়ে স্বপ্নাকে ফাঁসিয়েছেন। স্বপ্নাকে গ্রেফতার করেছেন এবং মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন, যা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিদর্শক রোকেয়া আক্তার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে জানান, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি গুলশান সার্কেলের অভিযানে তার নাম যুক্ত করা হয়েছে। ওই তারিখে তিনি অফিসের কার্যক্রম শেষে সন্ধ্যার পরে বাসায় ফিরে তার বড় ছেলেকে নিয়ে বনশ্রীতে ফরাজী হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী স্বপ্না আক্তার বলেন, আমাকে অন্যায়ভাবে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন। তদন্তে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই।
সাজ্জাদ হোসেনের আইনজীবী ফারুক হোসেন বলেন, স্বপ্না আক্তারকে ইয়াবাসহ গ্রেফতারের ঘটনায় করা মামলার সত্যতা না পেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। মামলার বাদী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিদর্শক শেখ সাজ্জাদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেছেন আদালত। আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে স্বপ্নাকে অব্যাহতি দিয়ে সাজ্জাদের বিরুদ্ধে মামলা করার আদেশ দেন। এরপর খিলক্ষেত থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আমরা আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন দাখিল করেছি। আদালত রিভিশন গ্রহণ করেছেন। রিভিশন গ্রহণের পর সাজ্জাদের বিরুদ্ধে মামলা চলতে পারে না।
তবে এ বিষয়ে জানতে সাজ্জাদ হোসেনের মোবাইলে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।