ঘোষণা ডেস্ক : নগরকে পলিথিনমুক্ত করতে একসঙ্গে কাজ করবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও জেলা প্রশাসন। এক্ষেত্রে আগামী দুই মাস পলিথিনবিরোধী প্রচারণা চালানো হবে। এরপর শুরু হবে অভিযান। অভিযানে বাজারে কোনো দোকানদার বা ব্যবসায়ীর কাছে পলিথিন পাওয়া গেলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে অভিযানে বেশি জোর দেয়া হবে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ যেসব কারখানায় পলিথিন উৎপাদন হয় সেখানেই অভিযান চালানো হবে। গতকাল অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বর্তমান পর্ষদের ২৭তম সাধারণ সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। আন্দরকিল্লা নগর ভবনের কেবি আবদুস সাত্তার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এতে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ এবং স্মার্ট চট্টগ্রাম বিষয়ক’ একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করেন তিনি।
পলিথিনবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি ফুটপাত দখলমুক্ত করা এবং জলাধার রক্ষাসহ বিভিন্ন নাগরিক ইস্যুতে চসিক ও জেলা প্রশাসন একসাথে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এই দুই সংস্থার প্রধান। মেগা প্রকল্পের আওতায় খালে দেয়া বাঁধ অপসারণ হয়েছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে চসিক, সিডিএ ও জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় পরিদর্শনেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় সিডিএর কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত না থাকা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। এছাড়া বায়েজিদ এলাকায় চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর তৎপরতা বৃদ্ধির অভিযোগ ওঠে। সভায় ওয়াসার পানির লবণাক্ততা নিয়ে ক্ষোভ জানান একাধিক কাউন্সিলর। লবণাক্ত পানির জন্য মানুষ কষ্ট পাচ্ছে জানিয়ে তারা দ্রুত এর সমাধান করতে ওয়াসার প্রতি আহ্বান জানান।
ওয়াসার প্রতিনিধি সভায় জানান, কাপ্তাইয়ে পানিপ্রবাহ না থাকায় কর্ণফুলীতে শ্যাওলা আসছে। সেজন্য উৎপাদন কমাতে হয়েছে। এর প্রভাবে হালিশহর–আগ্রাবাদ এলাকায় পানি সরবরাহ কিছুটা কমেছে। তবে ওসব এলাকার পানিতে লবণ নেই। আবার হালদায় সাগরের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করেছে। ফলে হালদা থেকে উৎপাদিত পানি শহরের যেসব এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে সেখানে লবণাক্ততা সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিকল্প নদী না থাকায় এ মুহূর্তে ওয়াসারও করার তেমন কিছু নেই।
মেয়র যা বললেন : ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতে লবণ থাকা নিয়ে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ওয়াসার লবণাক্ত পানি সরবরাহের ফলে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। সবাই ওয়াসার সামর্থ্যের ঘাটতির কথা বলছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দীর্ঘ সময়ের অনাবৃষ্টি, কাপ্তাই লেকে পানি শুকিয়ে গিয়ে শ্যাওলার জন্ম আর কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে নোনা পানির প্রবেশের কারণেই যে ওয়াসার পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে তা নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। পরিবেশ সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ডেল্টা প্ল্যান গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কেবল সরকারি উদ্যোগ নয়, সাধারণ মানুষেরও কিন্তু চট্টগ্রামকে পরিত্যক্ত নগরী হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, সৌন্দর্যবর্ধনের নামে চট্টগ্রামের ক্ষতি করা হয়েছে। বিপ্লব উদ্যানের মতো ঐতিহাসিক স্থানে দোকান বসিয়ে এর মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। ইজারাদাররা সেখানে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করছে। অথচ কর্পোরেশন লাখ টাকা পাচ্ছে। এই মহামূল্যবান স্থান ২৫ বছরের জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে। আমি ওখানের ব্যবসায়ীদের বলেছি, ব্যবসা করতে হলে বিপ্লব উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আর চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের জাদুঘর গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর সৌন্দর্যবর্ধনের নামে কর্পোরেশনের ভূমি ইজারা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি।
মেয়র বলেন, আমরাই সুন্দর চট্টগ্রামকে হীন স্বার্থে বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলছি। আমরা শুধু বস্তুগত উন্নয়ন নিয়ে ভাবছি। কিন্তু নাগরিকদের জীবনমান বিশেষ করে অবসর, বিনোদন আর পরিবেশের ভারসাম্যের কথা ভাবছি না। তিনি চট্টগ্রামের নাগরিকদের জীবনমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
চসিকের বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, শিশুরা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে করতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য খেলার মাঠ রাখব না, তাহলে তো কোনো সমাধান হবে না। আমি প্রতিটি ওয়ার্ডে পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি; যাতে শিশুরা খেলতে পারে, বয়স্করা অবসরে হাঁটতে পারে। এছাড়া জেলা প্রশাসন ও রেলওয়েকে তাদের ভূমিতে খেলার মাঠ ও পার্ক করার জন্য আমাদের দিতে প্রস্তাব দিয়েছি।
তিনি বলেন, মেয়রের পদে বসেই আমি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে আগ্রাবাদ ঢেবা ও পাহাড়তলী জোড় ঢেবার সৌন্দর্যবর্ধনে সিটি কর্পোরেশনকে দিতে বলি। তবে রেল কর্তৃপক্ষ সহায়তা না করায় সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আমি বলেছি, ভূমির মালিকানা সিটি কর্পোরেশনকে দিতে হবে না, আমাকে শুধু ভূমি দিন। আমি কর্পোরেশনের অর্থে পার্ক–মাঠ গড়ে দেব, শিশুদের ভবিষ্যৎ বাঁচাব। রানীর দিঘিকে দখলের হাত থেকে বাঁচানো গেলেও এখনও ষড়যন্ত্র চলছে।
মেয়র বলেন, পলিথিন, প্লাস্টিকের কারণে কর্ণফুলী নদী মৃত্যুর মুখে। কর্ণফুলী না বাঁচলে চট্টগ্রাম বাঁচবে না। তাই আগামী তিন মাসের মধ্যে পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করব। আর নদী অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদের পাশাপাশি পুনর্দখল রোধেও পদক্ষেপ নিব।
তিনি বলেন, নাগরিক সেবা প্রদানকে গতিশীল রাখতে আমি সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব আয় দিয়ে আন্দরকিল্লায় পুরাতন ভবনের স্থলেই ২১ তলা ভবন নির্মাণের কাজ মে মাসেই শুরু করব। তিনি নগরের নিউ মার্কেট, রেয়াজুদ্দিন বাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হকারদের মাধ্যমে অবৈধভাবে ফুটপাত দখল করে গড়ে ওঠা দোকান উচ্ছেদ, বহদ্দারহাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত রিকশা চলাচল বন্ধ, ফ্লাইওভারের নিচে এবং অন্যান্য উপযুক্ত স্থানে পে–পার্কিং চালুকরণে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।
জেলা প্রশাসক যা বললেন : জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, চট্টগ্রামকে ঢেলে সাজাতে সিটি কর্পোরেশন এবং জেলা প্রশাসন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে। একদিকে জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালাবে, অন্যদিকে উদ্ধার হওয়া ভূমিতে পার্ক, খেলার মাঠ আর রাস্তা বানাবে সিটি কর্পোরেশন। জলাধার রক্ষা, পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, ফুটপাত উদ্ধারসহ চট্টগ্রামকে স্মার্ট নগরীতে পরিণত করতে দুটি সংস্থা যৌথভাবে কাজ করবে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামকে স্মার্ট নগরে পরিণত করতে মেয়রের পরিবেশ নিয়ে জানানো উদ্বেগের সমাধানে কাজ করব। চট্টগ্রামের মেয়রের সহযোগিতায় আমি পলিথিনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করব। পলিথিনবিরোধী অভিযানে বিক্রেতার চেয়ে উৎপাদক পর্যায়ে জরিমানায় বেশি মনোযোগ দেয়া হবে। কারণ পলিথিনের সরবরাহ না থাকলে মানুষ পাটের ব্যাগ ব্যবহার করতে বাধ্য হবে।
অন্যান্য : সভায় পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবারক আলী অভিযোগ করেন, বায়েজিদ এলাকায় চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী এবং সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এ বিষয়ে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম জেলা প্রশাসকের কাছে কুলগাঁও বাস টার্মিনাল নির্মাণ, বিভিন্ন ওয়ার্ডে খাস জমি পুনরুদ্ধার করে বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণসহ চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নে সহযোগিতা চান।