ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলার নতুন চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শাহজালাল বলী। মাত্র ১ মিনিটেই তিনি হারিয়ে দেন গতবারের চ্যাম্পিয়ন চকরিয়ার তরিকুল ইসলাম জীবনকে।
মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) বিকেলে বলী খেলার ১১৪ তম আসরের ফাইনালে মুখোমুখি হন গতবারের দুই ফাইনালিস্ট। তবে ফলাফল হয়েছে ঠিক উল্টো। গতবার জীবন বলী জয়লাভ করলেও এবারে শাহজালালের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি তিনি। করোনা মহামারির আগে সর্বশেষ দুই আসরে (২০১৮ ও ১৯ সালে) শাহজালাল টানা চ্যাম্পিয়ন ছিলেন।
শাহজালাল আনসার ভিডিপির হয়ে পেশাদার কুস্তিগির হিসেবে বিভিন্ন কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। লালদীঘি মাঠের আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা বা বলীখেলায়ও তিনি বেশ কয়েকবার অংশ নেন।
বিকেল সাড়ে ৩ টায় শুরু এ বলীখেলায় চট্টগ্রাম ও বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মোট ৬০ জন বিশিষ্ট বলী অংশ নেন। এদের মধ্যে ১২ জন চূড়ান্ত পর্বে উন্নীত হন। এই ১২ জন থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেরা ৪ জন সেমি-ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন। প্রথম সেমি-ফাইনাল মুখোমুখি হন গতবারের চ্যাম্পিয়ন চকরিয়ার তরিকুল ইসলাম জীবন ও খাগড়াছড়ির সৃজন চাকমা। প্রায় ১১ মিনিট ৩৬ মিনিটের লড়াইয়ে সৃজন বলী হার মানেন জীবন বলীর কাছে। দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে কুমিল্লার শাহ জালাল বলীর সাথে লড়াইয়ে নামেন আনোয়ারার আবদুর নুর। মাত্র ১ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের লড়াইয়ে শাহজালাল বলীর কাছে হার মানেন আবদুর নুর বলী। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী পর্বে সৃজন চাকমা খুব সহজেই আবদুর নুর বলীকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।
খেলাশেষে বলীখেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী চ্যাম্পিয়ন শাহজালাল বলীর হাতে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি ও নগদ ৩০ হাজার টাকা এবং জীবন বলীর হাতে রানার-আপ ট্রফি ও নগদ ২০ হাজার টাকা প্রাইজমানি তুলে দেন। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, প্যানেল মেয়র আবদুস সবুল লিটন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। মেয়র বলেন, ‘বৃটিশ শাসনামল থেকে প্রতিরোধের বার্তা ছড়িয়ে আসছে জব্বারের বলিখেলা। বর্তমানে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ আর মৌলবাদীদের ষড়যন্ত্রে যে সাংস্কৃতিক সংকট তা রুখতে এবং তা থেকে আমাদের ঐতিহ্য বাঁচাতে জব্বারের বলিখেলা আর বৈশাখী মেলার মতো সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে বাঁচাতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনার অভিঘাত পেরিয়ে এবছর আমরা লালদীঘি ময়দানে বলিখেলার আয়োজন ফেরাতে পেরেছি। আমি যতদিন মেয়রের দায়িত্বে আছি এই বলিখেলার আয়োজনকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করে যাব। আমরা যারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোলমডেলে পরিণত করতে কাজ করছি তাদের মনে রাখতে হবে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ ছাড়া স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল আসবেনা।
এর আগে শুরুতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলার ১১৪ তম আসরের উদ্বোধন করেন।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলা আসলে এক ধরনের কুস্তি। ২০২৩ সালে ১১৪তম কুস্তির আসর ও মেলা বসেছে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘী ময়দানে। গ্রামীণ পণ্য নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে মেলায় আসেন বিক্রেতারা। হাতে বানানো পণ্যের কদর রয়েছে এ মেলাকে ঘিরে। বিশেষ করে গৃহসামগ্রী, শীতল পাটি, হাতপাখা ও মাটির পণ্যসামগ্রীর বেচাকেনা চলে। মেলার অন্যতম আকর্ষণ হলো কুস্তি বা বলী খেলা। বিভিন্ন রাউন্ডের এ কুস্তি দেখতে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কুস্তিগিররা এখানে আসেন ২৫ এপ্রিল বা ১২ বৈশাখে কুস্তি খেলায় অংশ নেওয়ার জন্য। একের পর এক কুস্তি প্রতিযোগিতা। কৌশলে কে কাকে পরাজিত করবেন- এ নেশায় মেতে উঠেন কুস্তিগিররা। করোনার কারণে ২০২০, ২০২১ সালে বলী খেলা হয়নি। নানা জটিলতায় ২০২২ সালে জমেনি মেলা ও খেলা। তাই ২০২৩ সালের বলী খেলাকে কেন্দ্র করে উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি নেই। মেলা শুরু হয়েছে ২৪ এপ্রিল; চলবে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত।
ব্রিটিশ আমলেই চট্টগ্রামে কুস্তি খেলার প্রচলন শুরু হয় ব্যাপকভাবে। তবে কারো কারো মতে, মোগল আমলেও গ্রামের যুবকদের মাঝে কুস্তির প্রতিযোগিতা ছিল। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি যুব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চলে নানাভাবে। তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম শহরের বদরপতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগরের মাথায় কুস্তি প্রতিযোগিতার বিষয়টি আসে। তিনি স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে যুবকদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও শক্তিমত্তা বাড়াতে ১৯০৯ সালে প্রথম কুস্তি প্রতিযোগিতা শুরু করেন। সেই থেকে প্রতি বছর ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে যেতেন। বিজয়ীদের পুরস্কৃত করতেন। জব্বারের মৃত্যুর পর তার নামেই জব্বারের বলী খেলার গোড়াপত্তন ঘটে। জব্বারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল লালদিঘী ময়দানের পাশে বদরপাতি নামক এলাকায়। নানা কারণে চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দান ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত ছিল। বিশেষ করে মোগল আমলে লালদিঘীর মাঠ ঘিরে গড়ে উঠেছিল নানা দুর্গ। পরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে লালদিঘী ময়দান ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তাই লালদিঘী ময়দানকে ঘিরে জব্বারের বলী খেলা ও মেলার আসর জমতে থাকে বছরের পর বছর ধরে। সূচনার ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর লালদীঘির মাঠে ১২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় বলী খেলা। বলী খেলার আগে এক দিন ও পরে এক দিন- তিন দিন ধরে লালদিঘীর পাড় ও আশপাশ এলাকায় প্রায় দুই বর্গকিলোমিটারজুড়ে বসে মেলা। বৈশাখ মাসে মেলা হয় বলে অনেকে বৈশাখী মেলা হিসেবেও আখ্যায়িত করে এটিকে।
তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো কক্সবাজার জেলার রামুর অধিবাসী দিদার বলীকে কেউ হারাতে পারতেন না। দিদার বলীকে এক নামে চেনেন চট্টগ্রামের মানুষ। ২০০২ সালে সিদ্দিক বলীর সঙ্গে যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন হন দিদার বলী। পরবর্তী সময়ে ২০০৪ থেকে ২০০৬, ২০০৮ থেকে ২০০৯ সালে খাগড়াছড়ির মর্ম সিংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন হন দিদার বলী। তবে ২০০৭ সালে মর্ম সিংকে হারিয়ে এককভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন দিদার। ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দিদার বলী অসদাচরণের জন্য বহিষ্কৃত ছিলেন। ২০১৩ সালে মাঠে ফিরে এসে টানা ২০১৫ সাল পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নের শিরোপা ধরে রাখেন। ১০৮তম আসর অর্থাৎ ২০১৭ সালে ১৩ বারের মতো চ্যাম্পিয়ন দিদার বলী সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ফাইনাল রাউন্ডে দিদার একই জেলার উখিয়ার শামসু বলীকে ১৭ মিনিটে ধরাশায়ী করেন। সে বছরই দিদার বলী অবসর নেন এই খেলা থেকে।
২০১৮ সালে নতুন চ্যাম্পিয়ন হন চকরিয়ার জীবন বলি। কুমিল্লার শাহজালাল বলীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। ২০১৯ সালে চকরিয়ার জীবন বলীকে হারানোর মাধ্যমে কুমিল্লার শাহজালাল বলী চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলী খেলার ১১০তম আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এই প্রতিযোগিতায় দুই বলীর ২৬ মিনিটের শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই হাজার হাজার দর্শক উপভোগ করেন। ২০১৯ সালের বলী খেলায় সরাসরি অংশ নেন ১৬ জন বলী। করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে বলী খেলা হয়নি। ২০২২ সালে নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে বলী খেলার ১১৩তম আসর অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ লড়াইয়ে অংশ নেন জীবন ও শাহজালাল বলী। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে জীবন বলী তার শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু ২০২৩ সালে আবারও হারানো শিরোপা উদ্ধার করে নেন কুমিল্লার শাহজালাল বলী।