
আগুন নেভাতে পানির সংকট কাটাতে চট্টগ্রাম নগরীতে বেদখল হওয়া পুকুরগুলো উদ্ধার করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। সোমবার(১০ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে ‘অগ্নি নিরাপত্তা জোরদার ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি’ নিয়ে দোকান মালিক সমিতি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি একথা জানান।
সম্প্রতি সীতাকুণ্ডে তুলার গুদামে আগুন নেভাতে পানির সংকটের উদাহরণ টেনে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরে যে পুকুরগুলো রয়েছে সেগুলো আমরা উদ্ধার করতে চাই। পুকুরগুলোর চারদিকে আমরা ওয়াকওয়ে বানাতে চাই। আসকারদিঘী, ঢেবারপাড়, বলুয়ার দিঘীসহ সব পুকুরের চারপাশে যে অবৈধ দখলদার আছে, তাদের উচ্ছেদ করা হবে।’
এছাড়া মার্কেটে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১১টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন। সংশ্লিষ্ট মার্কেটের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করলে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা। ব্যবসায়ীদের নিয়ে আয়োজিত বিশেষ সভায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভায় বক্তারা বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক অগ্নি দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে। অগ্নি দুর্ঘটনার ফলে ব্যপাক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে ব্যবসায়ীবৃন্দ বিনিয়োগ শূন্য হয়েছে। বিগত সপ্তাহে রাজধানীর বঙ্গবাজারে মার্কেটে অগ্নি দুর্ঘটনায় বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি সম্পূর্ণ হয়েছে। একই ঘটনা চট্টগ্রামের বিভিন্ন মার্কেটে না ঘটে সে বিষয়ে সতর্কতা ও কর্মপরিকল্পনা নেয়ার লক্ষ্য নিয়ে সভায় আলোচনা করা হয়েছে।
এসময় জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমাদেরকে জাতীয় দুর্যোগসহ অগ্নি দুর্ঘটনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্লান পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গবাজারের মত পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’
সভায় জেলা প্রশাসনের নেয়া ১১ সিদ্ধান্ত হলো:
১. প্রতিটি দোকানের ফায়ার লাইসেন্সসহ ফায়ারের অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র সংরক্ষণ করতে হবে। অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র হালনাগাদ (সচল) থাকতে হবে। দোকানদার ও কর্মচারীদের ফায়ার সার্ভিস থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবহার করতে হবে।
২. প্রতিটি মার্কেট সমিতির অগ্নি নির্বাপন সহ জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় নিজস্ব প্ল্যান থাকতে হবে।
৩. মার্কেট সমিতি বিভিন্ন পয়েন্টে সিসি ক্যামরা লাগাবেন। সিসি ক্যামরা নজরদারীর জন্য ৩ থেকে ৪ জন কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে। এই কর্মচারীরা পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করবেন।
৪. ডিস ও ইন্টারনেটের লাইন মাটির নিচে নেয়ার জন্য মার্কেট সমিতি ডিস ও ইন্টারনেটের মালিকগণকে অনুরোধ করবেন।
৫. ব্যক্তিমালিকানাধীন মার্কেটসহ, সিটি করপোরেশন, সিডিএ এর নিয়ন্ত্রাণাধীন মার্কেটগুলোতে ব্যবসায়ী সমিতিকে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। যাতে মার্কেটে পানির রিজার্ভ ট্যাংক, গাড়ি পাকিং এবং জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
৬. প্রতিটি বাজার ব্যবসায়ী সমিতি তাঁদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাজারে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করবেন। তাঁরা মার্কেট বা বাজার পরিদর্শন করে ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিকে নিরাপত্তার তথ্য জানাবেন।
৭. ফুটপাত অবমুক্ত করার জন্য সিটি করপোরেশনে চিঠি পাঠানো হবে।
৮. বৈদ্যুতিক লাইনের তার সময় উপযোগী করার জন্য বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে চিঠি পাঠানো হবে।
৯. জহুর হর্কাস মার্কেট দুইটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে হওয়ায় দুইটি পাহাড় হতে বড় বড় ট্যাংক বসানোর জন্য মার্কেট প্রতিনিধি নিজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং জেলা প্রশাসনের সহযোগীতায় কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
১০. মহানগর এলাকার পুকুরগুলো বেদখল হয়ে যাচ্ছে। পুকুরগুলো অবৈধ দখলদার মুক্ত করে চারদিকে হাঁটার জন্য ওয়ার্ক ওয়ে নির্মাণ করার বিষয়ে সিএমপি ও মিডিয়ার প্রতিনিধি নিয়ে একটি টীম গঠন করা হবে।
১১. ফায়ারের বিষয়ে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা বা প্রতিটি ব্যবসায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে তাদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের সভাপতিত্বে সভায় চট্টগ্রাম চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক অহিদ সিরাজ চৌধুরী স্বপন, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি চৌধুরী ফরিদ, জহুর হকার্স মার্কেট, রিয়াজুদ্দিন বাজার, চাক্তাই,খাতুনগঞ্জ, টেরিবাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ মার্কেটের ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
অগ্নিঝুঁকি কমাতে ব্যবসায়ীদের নিজস্ব পরিকল্পনা রাখার আহবান জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘বঙ্গবাজারে যে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণে কিন্তু অনেক ব্যবসায়ী সর্বশান্ত হয়ে পথে বসে গিয়েছেন। চট্টগ্রামেও ঘনবসতির মধ্যে যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে সেখানে আমাদের মোবাইল কোর্টগুলো রিয়াজউদ্দিনবাজারসহ আরও বিভিন্ন মার্কেটে গিয়েছে। সেখানে আমাদের টিম যে পরিস্থিতি দেখেছে ওইখানে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোথাও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই। যেগুলো আছে সেগুলোও মেয়াদ শেষ। আমরা যারা যে অবস্থানে আছি আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। প্রত্যেকের নিজস্ব একটি প্ল্যান থাকতে হবে।’
দুই-তিন হাজার টাকার জন্য অগ্নিনিরাপত্তাকে প্রাধান্য না দেয়া বোকামি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকটি মার্কেটে একটি এসেম্বলি পয়েন্ট থাকতে হবে। ভুমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ড হলে যাতে সবাই এসে সেখানে দাঁড়াতে পারে। পরীর পাহাড় ও জহুর হকার্সের পেছনে একটি পাহাড় আছে, যেটা টেলিকম কোম্পানি বিটিসিএলের। এখানে কোথাও ওয়াটার রিজার্ভার তৈরি করা যায় কি না, বণিক সমিতি আর্থিক বিষয়টি দেখবে। আমরা জায়গাটার বিষয়ে দেখবো।’
জেলা প্রশাসন থেকে তিন মাস আগেও অগ্নি নিরাপত্তা জোরদার করতে অভিযান চালালেও তেমন পরিবর্তন আসেনি, এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের সামনে কী ব্যবস্থা থাকবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর ৯টি ফায়ার কোর্ট করা হয়েছে, বিশটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে ৩৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে ও ১জনকে এক বছর জেলও দেওয়া হয়েছে। তারপরও অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমাদের পরবর্তী মোবাইল কোর্ট যে কোনোসময় শুরু হতে পারে।’
‘এসময় যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে আগুনের প্রতিকার ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ব্যাপারে আমাদের জিরো টলারেন্স। যেখানে অগ্নিঝুঁকি রয়েছে সেটা রোধ না করেন, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’