রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সংসদে তার শেষ ভাষণে গণতন্ত্রচর্চার কথা স্মরণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলে। দেশে গণতন্ত্র অব্যাহত থাকলে উন্নয়ন ও অগ্রগতি বেগবান হয়। আবার গণতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হলে উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। উন্নয়নকে স্থায়ী ও টেকসই করতে হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মজবুত করতে হবে, তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘গণতন্ত্রহীন অবস্থায় যে উন্নয়ন হয় তা কখনো সর্বজনীন হতে পারে না। সেই উন্নয়ন হয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক।’
সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে সবার সহায়তা করা উচিত বলে মন্তব্য করেন আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘রাজনীতি থেকে হিংসা-হানাহানি অবসানের মাধ্যমে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে হবে।’
গতকাল শুক্রবার জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তীতে সংসদে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন রাষ্ট্রপতি।
১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল বসেছিল জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. আবদুল হামিদের দ্বিতীয় মেয়াদ পূর্ণ হচ্ছে ২৪ এপ্রিল। পরপর দুইবার রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তিনি। নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেবেন মো. সাহাবুদ্দিন।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশেষ অধিবেশনে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদও উপস্থিত ছিলেন। নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সহধর্মিণী রাশিদা খানম অধিবেশন প্রত্যক্ষ করেন।
সংসদে দেওয়া ১৬ পৃষ্ঠার বক্তব্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, জাতীয় সংসদ ও দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে ৭ এপ্রিল একটি ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় দিন। তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের এই দিনে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে যাত্রা শুরু হয়েছিল সংসদীয় গণতন্ত্রের। তবে এই যাত্রার পেছনে রয়েছে ২৪ বছরের অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতনের করুণ ইতিহাস।
তিনি বলেন, ক্ষমতায় যাওয়া বা পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় নির্বাচন। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কখনো দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না বলে জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, তা রাজনৈতিক পরিবেশকে তমসাচ্ছন্ন করে তোলে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মহান সংবিধানের আলোকে জনগণ নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে দেশে গণতন্ত্রচর্চার ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ ও বেগবান করবে এটাই সবার প্রত্যাশা। গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য বা সেবা নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘মনে চাইল কোনো দেশ থেকে পরিমাণমতো গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানি করলাম, বিষয়টি এমন নয়। চর্চার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত ও শক্তিশালী হয়।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সংসদে সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যগুলো পড়লে বোঝা যায় সংসদকে কীভাবে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করতে হয়।
সংসদকে কার্যকর করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, জনগণ অনেক আশা নিয়ে আপনাদের নির্বাচিত করেছেন, যাতে তাদের কথা, চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাক্সক্ষা আপনারা সংসদে তুলে ধরেন। এটা আপনাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং নীতি-আদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোনো ভিন্নতা থাকতে পারে না।
আবদুল হামিদ বলেন, সার্বিকভাবে সংসদের মূল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও ভূমিকা রয়েছে। প্রথমত, সমাজের সব শ্রেণি, পেশা, জেন্ডার, মত ও পথের প্রতিনিধিত্ব করা; দ্বিতীয়ত, আইন প্রণয়ন ও সরকারের ব্যয় নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত বিষয়াদি এবং তৃতীয়ত, তদারকির মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। সংসদীয় পদ্ধতিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিগুলোকে সঠিকভাবে কার্যকর করা গেলে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
আইন প্রণয়নকাজে সংসদ সদস্যদের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদে প্রথিতযশা আইনজীবীদের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়তোবা সংসদে বিল আকারে উপস্থাপিত আইনের পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের জন্য বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, একজন সংসদ সদস্য ব্যক্তিগত কিংবা সমষ্টিগতভাবে জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে সন্নিবেশিত বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে সংসদের কাছে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারেন।
সংসদীয় কমিটির গুরুত্বের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রাণ হচ্ছে এই সংসদীয় কমিটি ব্যবস্থা। মিনি পার্লামেন্ট হিসেবে পরিচিত সংসদীয় কমিটি ব্যবস্থার কার্যকারিতার ওপর সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি রচিত।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ১৯৭২ সালের গণপরিষদ এবং ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের সদস্যদের বেশির ভাগই না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। বর্তমান সংসদে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে তোফায়েল আহমেদ, রাষ্ট্রপতি নিজে এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে আমির হোসেন আমু, মোশাররফ হোসেন, ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক ও রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু জীবিত আছেন। জাতীয় সংসদের ইতিহাস নতুন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য এই বিশেষ অধিবেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সংসদের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সময়ের এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা সব সময় মসৃণ ছিল না। গণতন্ত্রের পথে আমাদের অগ্রযাত্রা যখনই বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তখনই এর একটি প্রভাব পড়েছে জাতীয় সংসদের ওপর। গত দেড় দশকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে রাষ্ট্রপতি বলেন, গত ১৪ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও সুদৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সব যোগ্যতা অর্জন করেছে। তারই নেতৃত্বে দেশের গণতন্ত্র আজ নিরাপদ ও সুরক্ষিত। বর্তমানে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি ব্যতীত অন্য কোনো গোষ্ঠী বা অসাংবিধানিক শক্তির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ নেই।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, সংসদ সদস্যদের অভাব-অভিযোগ, সুখ-দুঃখ সবকিছুর খবর রাখতেন বঙ্গবন্ধু এবং প্রয়োজনে তাদের জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করতেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমি একদিন রিকশায় করে সংসদে (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) যাচ্ছি। কিন্তু গেটে যেতেই নিরাপত্তা প্রহরী রিকশা থামিয়ে দিয়ে বলল, “রিকশা ভেতরে যাবে না।” কিন্তু গাড়ি ঢুকছে অবলীলায়। নিরাপত্তারক্ষীকে অনেক যুক্তিতর্ক দিয়েও কাজ না হলে রিকশা ছেড়ে হেঁটেই সংসদে প্রবেশ করি এবং তাৎক্ষণিকভাবে সব ঘটনা উল্লেখ করে আমার অধিকার ক্ষুন্নের একটি নোটিস জমা দিই। একদিন পরেই তৎকালীন চিফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম (প্রয়াত) আমাকে নোটিস প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করেন। রাজি না হলে কিছুক্ষণ পরেই সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু নিজেই আমাকে ডেকে বললেন, “কী রে, তোর কী হয়েছে?” আমি বললাম, ‘গাড়িতে যারা আসে তাদের যেমন ড্রাইভার নিয়ে আসে, তেমনি আমাকেও রিকশার ড্রাইভার নিয়ে আসে। কিন্তু গাড়ি ঢুকতে কোনো বিধি-নিষেধ না থাকলেও রিকশা নিয়ে প্রবেশ করা যাবে না এটা তো ঠিক না। তাই আমি অধিকার ক্ষুণ্নের নোটিস দিয়েছি, প্রত্যাহার করতে চাই না।” বঙ্গবন্ধু সব শুনে পিঠে একখান কিল মেরে বললেন, “আচ্ছা এখন তুই নোটিস তুইলা ফালা। তোর তো গাড়ি নাই। দেখি কী করা যায়।” পরে অবশ্য একটা পুরনো গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছিল। যদিও সেটি কিনতে এবং মেরামত করতে নতুন গাড়ি কেনার সমানই খরচ হয়েছিল।’
সংসদের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতীয় সংসদে দেশের বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাদের মধ্যে ভিআইপি গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, তিন বাহিনীর প্রধান, রাজনৈতিক নেতা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও মিশনপ্রধানরা।