মো: জিয়াউল হক : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অর্জিত নতুন বাংলাদেশেও কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের পুরাতন স্বভাব বদলাতে পারেন নি। ঘুষ না পেলে চোখে কালো চশমা পরে বিভিন্ন অজুহাতে সেবাগ্রহীতাকে প্রতিনিয়ত হয়রানি করে যাচ্ছেন। এমনই ২জন কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত সহকারী পরিচালক মো: বিল্লাল হোসেন এবং সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তারা দালালদের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতাদের নিকট থেকে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মর্মে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চান্দগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের দীর্ঘদিনের অনিয়ম-দূর্নীতি প্রতিরোধে উপ পরিচালক হিসেবে তাজ বিল্লাহকে দায়িত্ব প্রদান করার পর পাসপোর্ট অফিস একেবারেই দূর্নীতিমুক্ত হয়ে যায়। তখন পাসপোর্ট করতে আসা জনসাধারণকে কোন ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। পরবর্তীতে উনার বদলী হলে বর্তমান উপ পরিচালক শরীফুল ইসলামের যোগদানের পরও জনসাধারণের মধ্যে স্বস্তি বিরাজমান থাকে। কিন্তু সহকারী পরিচালক হিসেবে শওকত মোল্লা যোগাদানের পর থেকে পুনরায় বাড়তে থাকে দালালদের দৌরাত্ম্য। এই দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তার লাগাম টানতে তাকে বদলী করা হলে যোগদান করেন বর্তমান সহকারী পরিচালক বিল্লাল হোসেন। তার যোগদানের পর থেকে পাসপোর্ট অফিস অনেকটা দালালদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তার সাথে হাত মিলিয়ে দূর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইয়াহিয়া খান। দালালদের গোপন সংকেত ছাড়া শতকরা ৫ শতাংশ আবেদনও গ্রহণ করা হয় না। দালাল ছাড়া ফরম জমা দিতে গেলে বিভিন্ন ছল-ছাতুরির মাধ্যমে আবেদন বাতিল করা হয়। অনেকে এসব ভোগান্তি-ঝামেলা এড়াতে দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট আবেদন জমা দেন। নিরূপায় হয়ে দালালের খপ্পরে পড়তে বাধ্য হন।
জানা যায়, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দৈনিক গড়ে ৩৫০-৪০০ জন লোক পাসপোর্টের আবেদন করেন। সেখানে প্রায় ৯৫ শতাংশ লোকই দালালের শরণাপন্ন হন। সেই হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ৪-৫ লক্ষ টাকার মার্কা বাণিজ্য হয়। তাই মাসে এই মার্কা বাণিজ্য প্রায় কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
যেসব অজুহাতে আবেদন ফেরত দেওয়া হয় :
সেবাগ্রহীতা সূত্রে জানা যায় , দালালরা ফরম জমাদানের সময় বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করেন। এসব সাংকেতিক চিহ্ন দেয়া ফরম অনায়াসেই গ্রহণ করা হয়। বিশেষ চিহ্ন না থাকলে হরেক রকম ভুলের অজুহাতে ফরম ফেরত দেয়া হয়। যেমন - বিবাহিত নারী-পুরুষের আবেদন গ্রহণ করার সময় বলা হয় নিকাহনামা ছাড়া আবেদন জমা নেওয়া হবে না। আসল কিংবা সম্প্রতি নেওয়া জাতীয়তা সনদ বাধ্যতামূলক, জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রদত্ত ঠিকানার সাথে আবেদনের হুবহু মিল না থাকা, ব্যাংক চালানের তথ্য বাংলায় লিখা, বয়স ২০ বছরের কম হলে পিতা/মাতাকে সাথে আনা বাধ্যতামূলক, পেশার ক্ষেত্রে এনআইডির গরমিল ইত্যাদি বিভিন্ন অজুহাতে আবেদন ফেরত দেওয়া হয়। পরক্ষণে দালালের সংকেত নিয়ে আবেদনটা পুনরায় জমা দিলে বিনা বাক্য ব্যয়ে আবেদন গ্রহণ করা হয়। কোন আবেদনকারী একসময় শ্রমিক বা ছাত্র ছিলেন সে বর্তমানে কৃষক বা বেকার হলে সেটা তো দোষের কিছু নয়। যদিও ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, চালক বা কোন টেকনিক্যাল পেশার পরিচয় দিলে সনদ বাধ্যতামূলক হলেও অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রে সেটার কোন প্রয়োজন নেই, শুধুই অজুহাত। একেবারে কোন অজুহাত না পেলে এনআইডি কার্ড থাকার পরেও মা-বাবার আইডি কার্ড লাগবে বলে ফেরত দেওয়া হয়। দালালের বিশেষ সংকেত দেওয়া বেশীরভাগ আবেদনে দেখা যায়, জাতীয়তা সনদ ভুয়া। এছাড়া অনেক সময় আবেদনকারীর চাপে আবেদন গ্রহণ করলেও বায়ো এনরোলমেন্ট করার সময় না অজুহাতে বায়ো এনরোলমেন্ট করা হয় না।
দুদকের নিষ্ফল অভিযান:
পাসপোর্ট অফিসের দূর্নীতি নিয়ন্ত্রণে মাঝেমধ্যে দুদক অভিযান পরিচালনা করলেও তা হয় নিষ্ফল। দুদক টিম দালালদের গোপন সংকেত সম্পর্কে বুঝতে না পেরে অভিযানের সময় শুধুমাত্র কয়েকজন দোষী আনসার/পুলিশ সদস্যদের উপর দায় চাপিয়ে কর্মকর্তাদের সতর্ক করার মধ্যেই অভিযান সমাপ্ত করা হয়। যেসব অজুহাতে আবেদন গ্রহণ করা হয় না সেসব একই সমস্যা থাকার পরেও আবেদন কেন গ্রহণ করা হয়েছে সেই বিষয়ে তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসতো প্রকৃত দোষীদের তথ্য। দুদককের অভিযানের পর কয়েকদিন মার্কা বাণিজ্য শীতল হলেও পরবর্তীতে আবারো মার্কা হয়ে শুদ্ধ আবেদনের মানদণ্ড।
দালাল সংকেতের ফি যত এবং যেভাবে সংগ্রহ করা হয়:
জানা যায়, পাসপোর্ট অফিসের সামনে ২০-২৫ জন দালাল দাড়িয়ে থাকেন। কোন লোককে আবেদন জমা দিতে না পেরে ঘুরাঘুরি করতে দেখলে তাকে ডেকে বিশেষ সংকেত বা মার্কা দিয়ে জমা করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিলে তারা ঝামেলা এড়াতে রাজি হয়। সব দালালের কিন্তু বিশেষ সংকেত দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। ৮-১০ জন দালাল এবং কয়েকটি এজেন্সি বিশেষ সংকেত ব্যবহার করে। গ্রামাঞ্চলের এজেন্সিগুলো এবং অন্য দালালরা তাদের কাছ থেকে মার্কা সংগ্রহ করে। দালালদের বিশেষ সংকেতের জন্য আবেদনকারীকে প্রদান করতে হয় ২০০০ টাকা। সেখান থেকে ১৬০০ টাকা অফিসের, বাকী ৪০০ টাকা দালালের কমিশন। একজন ৩য় শ্রেণির কর্মচারীর মারফতে সহকারী পরিচালক বিল্লাল হোসেনের কাছে পৌঁছে যায়। ২ দিন পরপর দালালদের কাছ থেকে এই টাকা সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া আনসার/পুলিশ নামদারী দালাল তো আছেই। কোন আবেদন জমা না হলে ১৫০০ টাকার বিনিময়ে তাদের জাদুতে ১ মিনিটে জমা হয়ে যায়। দিনশেষে প্রতি আবেদনের জন্য ১০০০ টাকা করে বুঝিয়ে দিয়ে বাকী ৫০০ টাকা তাদের পকেটে যায়।
কয়েকজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সহকারী পরিচালক এবং সুপারিন্টেন্ডেন্টের চাপে আমরা অনেকটা অসহায়। উনাদের নির্দেশমতো কাজ না করলে বদলীর হুমকী দিয়ে আমাদেরকে জিম্মি করে রাখা হয়। তাই সেবাপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে দেখেও করার কিছুই থাকে না।
কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, আবেদন জমা করতে না পেরে সহকারী পরিচালকের নিকট গেলে কোন প্রকার সহযোগিতা পাওয়া যায় না। তিনি সাফ জানিয়ে দেন কাউন্টারে আবেদন গ্রহণ না করলে তার কিছুই করার নেই।
সাতকানিয়া থেকে আগত একজন ভুক্তভোগী জানান, ছেলের পাসপোর্ট আবেদন করতে আসার সময় ভুলে মূল জাতীয়তা সনদ ফেলে আসার কারণে তার ছেলের আবেদনটি গ্রহণ করা হয়নি। পরে একজন দালাল ২ হাজার টাকার বিনিময়ে মার্কা দেওয়ার পর এখন জমা হলো।
আরেকজন ভুক্তভোগী জানান, তিনি চন্দনাইশ থেকে এসেছেন। তিনি পড়াশোনার সময় জাতীয় পরিচয় পত্রে পেশা ছাত্র দিয়েছিলেন, বর্তমানে বেকার রয়েছেন। তাই আবেদনে বেকার উল্লেখ করায় কাউন্টারে আবেদনটি গ্রহণ করা হয়নি। পরে উপ পরিচালকের কাছে গেলে তিনি বলে দেওয়ায় আবেদনটি গ্রহণ করেছেন।
সহকারী পরিচালক বিল্লাল হোসেন বলেন, আমার যতটুকু দায়িত্ব ততটুকু পালন করতেছি। কোন সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে অফিসের কোন লোক টাকা চাইলে সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আবেদন ফেরত দেওয়ার পরপর দালালের সংকেত পেয়ে কেন আবেদন গ্রহণ করা হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যিনি আবেদন গ্রহণ করেন তিনি সেটা ভালো জানবেন। তিনি আরো বলেন, লোকজন যাতে দালালের কাছে না যায় সেই ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছি।
উপ পরিচালক শরীফুল ইসলাম বলেন, দালালদের মার্কা কিংবা বিশেষ সংকেত সম্পর্কে তিনি অবগত নন। পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় দালালদেরকে আটক করা হয়। সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘবে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দালালদের সাথে কারো সম্পৃক্ততা থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান এই কর্মকর্তা।