ঘোষণা ডেস্ক :রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে সংস্কার আনতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ১০ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ‘ভারসাম্য’ আনার পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব দিয়েছে।
বুধবার(৯ অক্টোবর) গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের দলের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব তুলে ধরেন।
দলটির প্রস্তাবে নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অর্থবহ করতে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের ‘ব্যাপক সংস্কারের’ পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। দলটি বলেছে, সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না।
রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবে সংবিধান সংস্কার করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ‘ভারসাম্য’ এনে একই ব্যক্তির পর পর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকার সুযোগ বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু করা, সংবিধানে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা স্থায়ীভাবে সন্নিবেশ করা এবং রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নিয়ম বাতিল করার প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াত।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সময় অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে করা সব চুক্তি পর্যালোচনা করা; পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিধান করা; পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী’ উপাদান বাদ দেওয়া; সব শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে মহানবী (সা.)-এর জীবনী সংযোজন করা; নাটক, সিনেমাসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান ‘অশ্লীলতামুক্ত’ করা; প্রাণীর মূর্তিনির্ভর ভাস্কর্য নির্মাণ না করা এবং বিতর্কিত সব বই বাতিল ও প্রকাশনা বন্ধ করার সুপারিশ রয়েছে জামায়াতের প্রস্তাবে।
সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, মূলত জামায়াতের সংস্কার প্রস্তাব ৪১ দফা, সেটা বিস্তারিত। এখন সংক্ষেপে ১০ দফা প্রস্তাব দেওয়া হলো।
শফিকুর রহমান আরো বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার সব কটি করে দিলে নির্বাচিত সরকার এসে কী করবে? আমরা নির্বাচিত সরকারকেও পরীক্ষা করতে চাই। যখন আমরা বিরোধী দলে থাকি, আমাদের কণ্ঠ-আওয়াজ হয় এক রকমের, আর সরকারে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে যাই।
তাই আমিসহ আমাদের সবাইকে পরীক্ষা করতে চাই।’
শফিকুর রহমান বলেন, ‘দেড় সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অর্থবহ করার জন্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন।
রাষ্ট্র সংস্কারে সরকারের কাছে জামায়াতের ১০ দফা প্রস্তাব—
আইন ও বিচার
উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের জন্য সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, বিচার বিভাগ থেকে দ্বৈতশাসন দূর করতে হবে, বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথককরণের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, আইন মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা করে সুপ্রিম কোর্টের অধীন পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে বিদ্যমান আইনগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধনী ও গণমানুষের মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আইন প্রণয়ন করতে হবে, সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ ও সব কালো আইন বাতিল করতে হবে।
সংসদবিষয়ক সংস্কার
সংসদের প্রধান বিরোধী দল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার মনোনীত করতে হবে, সংসদীয় বিরোধীদলীয় নেতার নেতৃত্বে ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, সংসদে বিরোধীদলীয় সদস্যদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা (পিআর) চালু করতে হবে, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা সংবিধানে স্থায়ীভাবে সন্নিবেশিত করতে হবে, নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন দেশে প্রত্যাখ্যাত ইভিএম ভোটিং ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে, কোনো সরকারি চাকরিজীবী তাঁদের চাকরি ছাড়ার কমপক্ষে তিন বছরের মধ্যে কোনো ধরনের নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করতে হবে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন একাধিক দিনে অনুষ্ঠিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবস্থাপনা নির্বাচন কমিশনের অধীন আনতে হবে।
আইন-শৃঙ্খলা সংস্কার
পুলিশ বাহিনীর সংস্কার : ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত পুলিশ আইন পরিবর্তন এবং পুলিশের জন্য একটি পলিসি গাইডলাইন তৈরি করতে হবে, পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং চাকরিচ্যুতির জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ব্যক্তির সুপারিশের সুযোগ রাখা যাবে না, পুলিশের মধ্যে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বাতিল করতে হবে, রিমান্ড চলাকালে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে আসামিপক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতি এবং মহিলা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁদের অভিভাবকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে, ‘পুলিশ আইন’ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করতে হবে।
র্যাববিষয়ক সংস্কার
র্যাব ও অন্যান্য বিশেষায়িত বাহিনীর প্রতি জনসাধারণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে, গত সাড়ে ১৫ বছর যাঁরা র্যাবে কাজ করেছেন, তাঁদের নিজ নিজ বাহিনীতে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তাঁদের পুনরায় র্যাবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না, বিচারবহির্ভূত সব ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।
জনপ্রশাসন সংস্কার
জনবল নিয়োগ, বদলি, পদায়নে তদবির, সুপারিশ ও দলীয় আনুগত্যের পরিবর্তে যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততাকে প্রাধান্য দিতে হবে, যেকোনো চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে নিয়োগ পর্যন্ত সময়ক্ষেপণ না করে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। সরকারি চাকরিতে আবেদন বিনা মূল্যে করতে হবে, চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা আগামী দুই বছরের জন্য ৩৫ বছর ও পরবর্তী বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩৩ বছর এবং অবসরের বয়সসীমা ৬২ বছর নির্ধারণ করতে হবে।
দুর্নীতি
দুর্নীতি দমন কমিশনে পরীক্ষিত সৎ, ন্যায়পরায়ণ, দক্ষ ও যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে হবে। রাষ্ট্রের সব সেক্টরে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে, বিগত সরকারের আমলে দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার উপযুক্ত বিধান প্রণয়ন ও তা কার্যকর করার পদক্ষেপ নিতে হবে, মন্ত্রণালয় ভিত্তিক দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করতে হবে, দুর্নীতি দমন কমিশনের আইন সংস্কার, জনবল ও পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে।
সংবিধান সংস্কার
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখার বিধান সংযুক্ত করতে হবে। একই ব্যক্তি পর পর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংস্কার
পাঠ্যপুস্তকে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে। সব শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী উপাদান বাদ দিতে হবে। সব শ্রেণিতে নবী করিম (সা.)-এর জীবনীসহ মহামানবদের জীবনীসংবলিত প্রবন্ধ সংযোজন করতে হবে। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার মূল ধারায় যুক্ত করতে হবে। ‘ডিপার্টমেন্ট অব হায়ার এডুকেশন’ নামে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে।
(খ) সংস্কৃতি সংস্কার
জাতির ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও মূল্যবোধের আলোকে বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। জাতির ঐতিহাসিক দিনগুলোকে স্মরণীয় করার লক্ষ্যে বিশেষ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তা পালনের ব্যবস্থা করতে হবে। নাটক, সিনেমাসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান অশ্লীলতামুক্ত করতে হবে। প্রাণীর মূর্তিনির্ভর ভাস্কর্য নির্মাণ না করে দেশীয় প্রকৃতি, ঐতিহ্যকে বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন-ভাস্কর্যে তুলে আনতে হবে।
পররাষ্ট্রবিষয়ক সংস্কার
পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সাম্য ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় চীন, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানিবণ্টন চুক্তির উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশকে আসিয়ান জোটভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শক্তিশালী সার্ক পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি অথবা সমঝোতা চুক্তি হলে পরবর্তী সংসদ অধিবেশনে সেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক উত্থাপন করে আলোচনাপূর্বক তা অনুমোদন করতে হবে।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সংস্কার
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে (ইফাবা) রাষ্ট্রের কল্যাণে অর্থবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। হজ ব্যবস্থাপনার জন্য স্বতন্ত্র অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিতর্কিত সব বই বাতিল ও প্রকাশনা বন্ধ করতে হবে। সব ধর্মাবলম্বীর ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন দলের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, আ ন ম শামসুল ইসলাম, এ টি এম মাছুম, কেন্দ্রীয় নেতা সাইফুল আলম খান, রফিকুল ইসলাম খান, মতিউর রহমান আকন্দ, হামিদুর রহমান আযাদ, আবদুল হালিম, এহসান মাহবুব জোবায়ের, নুরুল ইসলাম বুলবুল, সেলিমউদ্দিন ও মোবারক হোসন।